ওয়েব সিরিজ :: রিফিউজি । পরিচালনা :: ইমতিয়াজ হোসইন সজিব । অভিনয়ে :: সোহেল মন্ডল, জাকিয়া বারী মম, আফজল হোসেন ও আরো অনেকে পর্ব :: ০৬ । সিজন -০১
ওয়েব সিরিজ :: রিফিউজি ।
পরিচালনা :: ইমতিয়াজ হোসইন সজিব ।
অভিনয়ে :: সোহেল মন্ডল, জাকিয়া বারী মম, আফজল হোসেন ও আরো অনেকে
পর্ব :: ০৬ ।
সিজন -০১
আমার অনুভূতি ::
🀄 এই জুন মাসের ১০ তারিখে মুক্তি পেয়েছে আরো একটা বাংলা ক্রাইম -থ্রিলার ওয়েব সিরিজ " রিফিউজি " , বেশ কিছুদিন ধরেই নেট দুনিয়ায় ওয়েব প্রেমী দর্শকদের মধ্যে এই সিরিজটি নিয়ে একটা আলাদা আকর্ষণ তৈরী হয়েছিল, সেটা অনুভব করতে পারি । বিশেষ করে ট্রেলার রিলিজ হবার পর থেকে । পুরো সিরিজটা দেখার পরে আমার মনে হয়েছে রিফিউজির গল্পের বিষয়টি ঠিকঠাক বুঝতে হলে ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানা খুবই দরকার, অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই ইতিহাসটি জানা না থাকলে দর্শকরা ওয়েব সিরিজের পুরো গল্পটি ভালোভাবে অনুধামন করতে পারবেন না,
তাই আমার মনে হয়, রিফিউজি কারা বা কেন ? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের আগে খোঁজা দরকার ।
🎴 এখানে কারা রিফিউজি ??
রিফিউজি মানে উদ্বাস্তু, মানে যাদের কোনো ঘড় নেই ,বাসস্থান নেই, অথবা বিশেষ কারণে তারা নিজেরদের বাসস্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।।
১০ জুন ২০২২ সালে রচিত এই গল্পে যাদেরকে রিফিউজি বলে চিন্হত করা হচ্ছে, তাদের ইতিহাসটা শুরু অনেক আগে, ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ । যখন দুটো ঘটনা সমগ্র উপমহাদেশ নড়িয়ে দিয়েছিলো এক আমাদের দেশভাগ ও দুই দেশভাগকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম ব্যাপক দাঙ্গা হাঙ্গামা । যার ফলে প্রায় ২ কোটির বেশি মানুষের নিজের বাসস্থান ছেড়ে অন্য অপরিচিত জায়গায় প্রস্থান করতে বাধ্য হয়। এই সময় বিহার থেকে ১৫ লাখের বেশী বিহারি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভারত ত্যাগ করে বাংলাদেশে বা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক নতুন পরিচয় পাবার আশায়। ধর্মের দিক দিয়ে এরা সকলে মুসলিম হলেও এদের ভাষা ছিলো উর্দু ও বিহারী-হিন্দি। ভাষাগত বিভেদ ছাড়াও সামাজিক, সংস্কৃতিক ও পারিবারিক প্রথা কোনো দিক থেকেই পূর্ব বাংলার বৃহত্তর বাঙালি জন গোষ্ঠীর সাথে এদের কোনো রকমের মিল ছিলো না, এমনকি দৈহিক আকৃতি বা চেহারার দিকেও অমিল ছিলো চোখে মতন। ফলে ধর্ম এক হওয়া সত্তেও প্রথম থেকেই বাঙালিদের সাথে এদের কোনো রকমের বোঝাপরা গড়ে ওঠে না । একই দেশে বসবাস করলেও এরা বাংলাভাষা বা বাঙালি ঐতিহ্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণা প্রশন করতো না এবং সম্পর্ক গড়ে তুলতে রাজি ছিলো না ।
১৯৭১ সালে বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা দাবিতে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন এই বিহারী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। তারা সরাসরি পাকিস্তানী বাহিনী কে সাহায্য করে। এদের নিয়ে তৈরী হয় রাজাকার, অল বদর মতন প্যারালাল ঘাতক বাহিনী । যারা পাক সরকার ও সেনাবাহিনীর মদতে বাঙালিদের উপরে অত্যাচার শুরু করে, মুক্তি বাহিনী গোপন খবর সরবরাহ করে এবং আরো বিভিন্ন ধ্বংসত্মক কাজে লিপ্ত হয় । বাঙালীরাও এদের ক্ষমা করে নি, তাই পাক বাহিনীর আত্মসমর্পন করলে শুরু হয় এদের উপরে পাল্টা প্রতিশোধ ও আক্রমণ । ৫ লক্ষের বেশি বিহারী মুসলিম মারা যায় । বাকিদের মধ্যে কিছু ভয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়, আর বেশিরভাগ বাঁচার উপায় না পেয়ে আত্মসমর্পন করে । স্বাধীন বাংলাদেশে এদের বলা হয় "আটকে পরা পাকিস্তানী " । প্রচন্ড ঘৃণা দৃষ্টিতে এদের দেখা শুরু হয়।
পরে I. C. R. C [ International Committee Of Red Cross ] এর সহযোগিতায় এই আটকে পরা বিহারি জন্য বাংলাদেশ তৈরী হয় ১১৬ টি ক্যাম্প। আনুমানিক ৬ লক্ষের বেশি বিহারি সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই সমস্ত ক্যাম্প গুলিতে বসবাস করতে শুরু করে । এই মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ক্যাম্প হলো ঢাকার মোহাম্মদপুরের ' জেনেভা ক্যাম্প' [ যেহেতু আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ড এর জেনেভা শহরে সেই জন্য এই রকমের নাম ]
আর এই জেনেভা কাম্প আমাদের আজকের এই ওয়েব সিরিজের গল্পের মূল কেন্দ্রভূমি । এই সব ক্যাম্পে যে বিহারীরা মুসলিমরা থাকেন তাদেরকেই বাংলাদেশে রিফিউজি বলা হয় । আজকের এই গল্প এদের কে নিয়ে । স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এই সমস্ত ক্যাম্প গুলোতে কি ভাবে এই মানুষ গুলো বসবাস করছে, ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা ছাড়া, এমনকি একটা দেশের মধ্যে বসবাস করেও তাদেরকে দেখা হয় বিদেশী শত্রু হিসাবে। তাইতো কোন বৈধ নাগরিক পরিচয় পত্র তাঁদের নেই । রাষ্ট্র আসলে তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই চায় না, অথচ এই ক্যাম্পের নতুন প্রজন্ম যাদের জন্ম ১৯৭১ পরে স্বাধীন বাংলাদেশে, তারা এই দেশকেই নিজের দেশ হিসাবে মানতে চায়, নাগরিকত্ব পেতে চায় । এই সব মানুষদের গল্প , তাদের যুদ্ধ , কষ্ট , সুন্দর এক জীবনের স্বপ্ন এই সব কেন্দ্র করেই পরিচালক এই ওয়েব সিরিজটি বানিয়েছেন ।
জেনেভা ক্যাম্প
🧧 সংক্ষেপে রিফিউজির গল্প ঃঃ
আজকের গল্পের পেক্ষাপট ২০০৭ সাল , এই সময় বাংলাদেশের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টর কাছে পাক্কা ইনফর্মেশন আসে মারাত্মক ইন্টারন্যাশনাল আতঙ্কবাদী [ তার আসল নাম কেউ জানেনা ] পুলিশের খাতায় কোড নাম কা-র্ব-ন [ অভিনয়ে আফজল হোসেন ] বহুদিন দেশ ছাড়া ও নিখোঁজ আবার দেশে ফিরে এসেছে , বড় কিছু ঘটাতে , তার টার্গেট ঢাকা শহর । কার্বনের কেস ইনভেস্টিগেশনের দ্বায়িত্ব আছে এক জেদি মহিলা অফিসার মারিয়া । [ অভিনয়ে জাকিয়া বারী মম ]
জাকিয়া বারী মম ওরফে মহিলা অফিসার মারিয়া
তার কাছে ইন্টেল আছে কার্বন মহাম্মদপুরের জেনেভা বস্তিতে লুকিয়ে আছে । কিন্তু এত বিরাট বড় জায়গায় সঠিক ইনফরর্মেশন ছাড়া তাকে খুজে বের করা অসম্ভব । তাই মারিয়া কার্বনের লোকেশন ট্রাক করার জন্য তুলে এনেছে এই বস্তির একজন নতুন প্রজন্মের বিহারী রিফিউজি ছেলে ইকবালকে , [ অভিনয়ে সোহেল মণ্ডল ] ইকবাল এই বস্তির একজন ছোটখাটো ড্রাগ ডিলার । সে পুলিশকে সাহায্যের বিনিময়ে নিজের ভাইকে জেল থেকে ছাড়াতে চায় তারপরে মা আর ভাই কে নিয়ে এই বস্তি থেকে দূরে চলে যেতে চায় । সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চায় । প্রথম দিকে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিষ্কার হলেও ঘটনা যত এগোতে থাকে সে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পরতে থাকে কার্বন নামক রহস্যময় সন্ত্রাসবাদীর কার্যকলাপের সাথে । অন্যদিকে তার স্বপ্নচারী ইমোশনাল বন্ধু ওয়াসিম [ অভিনয়ে সিরাজ সরিফ ] স্বপ্ন দেখে একদিন তাদের সব সমস্যা দূর হবে ,তারাও সন্মান মর্যাদা পাবে । দেশ তাদের অধিকার স্বীকার করবে, নতুন ভাবে জীবন শুরু হবে । প্রথম দিকে সে কার্বনকে সাহায্য করলেও আস্তে আস্তে সে নিজের ভুল বুঝতে পারে , নিজেকে পরিবর্তন করতে চায় , সে বুঝতে পারে পাকিস্থান না তাদের দেশ আসলে বাংলাদেশ । সে বন্ধু ইকবাল কে সে সঠিক পথে আনতে চায় , অন্যদিকে জেদি ইনভেস্টিগেশন অফিসার মারিয়া, যার বাবা একজন প্রাক্তন মুক্তি যোদ্ধা এবং পাক বাহিনীর অত্যাচারে মানসিক ভাবে বিকালঙ্গ অথর্ব , সে কোন ভাবেই কার্বন কে ছাড়তে রাজি নয় । অন্য দিকে কার্বন যে আসলে একজন রাজাকারের সন্তান যে চোখের সামনে নিজের বাবার হত্যা দেখেছে , মনেপ্রানে ঘৃণা করে এই দেশকে সে যে কোনো ভাবেই প্রতিশোধ নিতে মরীয়া । এইভাবেই আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোনে গল্প এগিয়ে চলে । সিরিজে পরিচালক দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন বন্ধুত্ব না জাতিগত পরিচয় না দেশপ্রেম কোনটা বেশি বড় একজন মানুষের কাছে ? পরিস্থিতি অনুসারে আমাদের কাছে তা ঠিক করা মুস্কিল হয়ে যায় , সেই জন্য এই গল্প বারবার ভিন্ন ভিন্ন দিকে মোড়ে নিয়েছে । গল্পের বিভিন্ন জায়গায় কে বন্ধু আর কে যে প্রতি পক্ষ বাছাই করা মুস্কিল হয়ে গেছে । কলিযুগের এই মহাযুদ্ধে কে ঠিক আর কে যে ভুল , সত্যি তার বিচার অসস্থিকর ।
আফজল হোসেন ওরফে কার্বন
🌈 আমার ভালোলাগা ঃঃ
প্রথমেই কুর্নিশ জানাতে পরিচালক মহাশয়কে হয় এরকম একটা সংবেদনশীল অথচ মর্মস্পর্শী বিষয়কে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য । স্বকীয়তার , প্লট মেকিং ও ফ্লিম মেকিং দিক দিয়ে বাংলা ওয়েব সিরিজ গুলো যে কতটা এগিয়ে গিয়েছে এই সিরিজটা দেখলে দর্শকেরা সেটা বুঝতে পারবেন ।
অভিনয় দিক থেকে সবাই তাদের সেরাটা দেবার চেষ্টা করেছেন । সোহেল মণ্ডল যথারীতি খুবই ভালো অভিনয় করছেন । তিনি এখানে সম্পূর্ণ আলাদা একটা চরিত্রকে অসাধারন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । জেদী পুলিসের চরিত্রে জাকিয়া বারী মমের অপূর্ব অভিনয় এছারা সিরাজ সরিফ ও কার্বনের চরিত্রে আফজল হোসেনের অভিনয়ও মনে দাগ কেটে যায় । সব মিলিয়ে ৬ পর্বের এই ক্রাইম -থ্রিলার দর্শকদের কাছে যথেষ্ট উপভোগ্য , তবে এই প্লট অবশ্যই আমাদের ভাবতে বাধ্য করবে নতুন করে, শুধু মাত্র দূভাগ্যের কারণে দেশভাগের অপরিসীম যন্ত্রণার মাসুল এখনো ভোগ করতে হচ্ছে নতুন প্রজন্মের এমন কিছু মানুষকে , যাদের এই বিষয়ে কোন ভূমিকায় ছিলো না ।
সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন ।।
𝓐𝓾𝓽𝓱𝓸𝓻𝓲𝓽𝔂 𝓞𝓯
🆁︎. 🆂︎🆄︎🅱︎🅷︎🆁︎o







মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন